মা, মায়ের ভালোবসা, বাবার ভালোবাসা, মা বাবার ভালোবাসার গল্প, ভালোবাসা,
মায়ের ভালবাসা


-আবির ওঠ, বাজারে যাবি না বাবা?
-ভাল লাগছে না মা, আজ বাজারে যাবো না।
-ঘরে রান্না করার মত যা আছে সেগুলা তো তুই খাবি না, বাজারে না গেলে খাবি কি?
-ধুর, এই সকালে বাজারে যেতে আর ভাল লাগে না।
-বাজারে যেতে ভাল লাগবে কেন? ভাল লাগে শুধু বসে বসে খাওয়া।
-সকাল বেলা একটুও ঘুমাতেও দিবা না তুমি? ঠিক আছে টাকা দাও.....
রাগে গজরাতে গজরাতে আবির ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেস হয়ে বাজারে যায়। বাজার থেকে ছোট একটা পাঙ্গাস মাছ ও কিছু কাচা-বাজার কিনে আনে। বাজারগুলো সে তার মায়ের হাতে দিয়ে বলে.......
-তাড়াতাড়ি রান্না করো, মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে স্কুলে যাবো।
-এখনি রান্না করবো নাকি? এখন অন্য কিছু দিয়ে খেয়ে যা, রাত্রে মাছ দিয়ে ভাত খাস।
-রাত্রেই যদি খাব তাহলে এখন বাজারে গেলাম কি করতে!!
আবারো মায়ের সাথে রাগ করে গোছল করতে যায় আবির। আবির এবার সপ্তম শ্রেনীতে পড়ে কিন্তু এই বয়সেই তার যে রাগ তাতে আবিরকে নিয়ে একটু টেনশনেই থাকে পরিবারের লোকজন। আবিরের পরিবারে আছে তার মা-বাবা ও ছোট একটা বোন।
গোছল করে খাওয়ার সময় আবির দেখে আলুভাজি ও ডিম ভাজি, যদিও এগুলা আবিরের পছব্দের খাবারের মধ্যে পরে তবুও সে রেগে যায়। চিৎকার করে ডাকে.....
-মা.....মা!
-কি হয়েছে, ডাকছিস কেন?
-মাছ আনলাম যে, মাছ কই?
-এতো তাড়াতাড়ি মাছ রান্না হয় নাকি তাই ডিম ভেজে দিসি, স্কুল থেকে এসে মাছ দিয়ে খাস।
-আমি এগুলো দিয়ে খাবো না।
-কেন এগুলা কি খারাপ খাবার নাকি? মানুষ খায় না এগুলা?
-মানুষ খায় কিন্তু আমি খাবো না, সকালে বাজার থেকে মাছ আনলাম কিন্তু খাওয়ার সময় এই ছাই!
-কি জমিদার হয়ে পরেছিস যে ডিম আর আলুভাজি দিয়ে খাওয়া যাবে না।
-জমিদার আমি না, জমিদার হয়েছ তুমি। মাছটা পর্যন্ত রান্না করতে পারলে না।
-কি বলছিস তুই এগুলা, আমি জমিদার হয়ে পড়েছি!!
আবির তখন একটু অপস্তুত হয়ে পরে অনিচ্ছা সত্তেও কথাটা বলার জন্য কিন্তু নিজের রাগটা বজায় রাখার জন্য না খেয়েই স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হয়, যাওয়ার সময় আবিরের ছোট বোন আবির কে বলে.....
-ভাইয়া, ভাত না খেয়েই স্কুলে যাবা?
-হুম, খাবো না।
-কেন খাবা না?
-সেটা কি তোকে বলতে হবে? এক থাপ্পর মারবো, সর সামনে থেকে।
আবিরের বোনও আবিরের মায়ের মত মুখটা কালো করে কিছু না বলে সরে দাড়ায়।
রাস্তায় যাওয়ার পর আবির ভাবে কার মুখ দেখেছিলাম যে আজকে ঘুম থেকে উঠে যার জন্য পুরো সকালটাই খারাপ গেল আবার না খেয়েই স্কুলে যেতে হচ্ছে।
আবিরের মা ছেলের রাগ দেখে নিজেও একটু রাগ করেছিল কিন্তু ক্ষুধার্থ ছেলের কথা চিন্তা করে রাগটা থাকল না। ঠিকই তো এতো কষ্ট করে ছেলেটা মাছ আনলো, খেয়ে স্কুলে যেতে চাইলো কিন্তু মাছ না পাওয়ায় না খেয়েই চলে গেল। একটু তাড়াতাড়ি করলেই তো মাছটা রান্না হয়ে যেত আর না খেয়ে স্কুলে যেতে হত না। তখন আবিরে ছোট বোন এসে তার মায়ের কাছে বললো........
-মা, ভাইয়া তো না খেয়েই চলে গেল।
-যাবে না, জমিদার ছেলে। ডিম দিয়ে চলবে না মাছ, মাংশ চাই সব সময়।
-ভাইয়া তো তাহলে সারাদিন না খেয়ে থাবে, টিফিটও তো নেয় নি।
-থাক না খেয়ে, খেতে কি আমি মানা করিছিলাম নাকি!!
বলার পরই আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল ছেলের জন্য মায়ের।
স্কুলের ক্লাস শুরু হয় ১০.১৫ মিনিটে, একটা ক্লাস হতে ৪৫ মিনিট লাগে.....
১ম ক্লাস শেষ হয় আবিরের ১১টায়....
৫মিনিটের বিরতির জন্য আবির যখন বাইরে যায় তখন দেখে তার মা ও ছোট বোন দাড়িয়ে আছে স্কুলের মাঠের এক পাশে.....
-এখনে আসছো কেন?
-না খেয়েই চলে আসলি, তাই খাবার নিয়ে আসছি, খেয়ে নে।
-এখন খাবো কি ভাবে, ক্লাস আছে তুমি চলে যাও, আমার খাওয়া লাগবে না।
-খেতে আর কতক্ষন লাগবে, খেয়ে না।
-আমি এখন খাবো না।
বলেই আবির আবার মাঠ থেকে স্কুলের ক্লাসে চলে আসলো। ক্লাসে বসে ভাবছিল, খাবারটা নিয়ে আসলেই ভালো হত, টিফিনের সময় খাওয়া যেত। ক্ষিধেও তো কম লাগে নি। ক্লাস শুরু হওয়ার পর আবির ক্লাসে মন দিল ও সে ভুলেই গেল তার মা ও বোন যে এসেছে। যখন মনে পড়লো তখন ৪ টা ক্লাস শেষ হয়ে টিফিনের ঘন্টা দিচ্ছে।
আবির ভাবলো হয়তো তার মা ও বোন চলে গেছে ৩ ঘন্টা তো আর তার জন্য দাড়িয়ে থাকবে না খাবার নিয়ে। সে আর ক্লাস রুম থেকে বেড় হলো না, বেঞ্চেই বসে রইলো। হঠাৎ কেউ যেন পিছন থেকে ভাইয়া বলে ডেকে উঠলো, আবির পিছন ফিরে দেখে তার ছোট বোন.......
-তুই এখনো যাস নাই?
-না, মা তোমার জন্য দাড়িয়ে আছে এখনো।
-এখনো দাড়িয়ে আছে! কোথায়?
-মাঠেই দাড়িয়ে আছে।
-কেন? লাইব্রেরিতে এসে বসে থাকলে কি হতো?
-আমি জানি না, মা মাঠের কিনারে গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে সেই তখন থেকেই।
আবির মাঠে গিয়ে দেখে তার মা এখনো তার জন্য খাবার নিয়ে দাড়িয়ে আছে প্রচন্ড রোদ আর গরমের ভিতর একটা গাছের নিচে।
-তোমাদের না তখনি বললাম আমি খাব না, তো এতক্ষন দাড়িয়ে আছো কেন?
-রাগ করিস না, সকালে না খেয়ে চলে আসলি, তাই খাবার নিয়ে আসলাম। খেয়ে নে।
-আমি এখন খাবো না, তোমরা বাড়ি চলে যাও।
-খেয়ে নে, সেই তখন থেকে দাড়িয়ে আছি। মায়ের কষ্টটুকু বঝবি না?
-ঠিক আছে, খাবো। তোমারা বাড়িতে যাও।
-তুই আগে খাবি, তারপর আমরা যাব।
আবির তখন রাগ ভুলে খাওয়ার জন্য নিদ্দিষ্ট যে রুমটা আছে সেখানে গিয়ে দেখে সবার খাওয়া হয়ে গেছে, সবাই বাইরে চলে যাচ্ছে। সে যখন খাওয়া শুরু করবে তখন মনে পড়লো পানি আনা হয় নি। আবিরের মা তখন বললো.....
-তুই বোস, আমি পানি নিয়ে আসছি।
-ঠিক আছে।
আবিরের মা বাইরে যাওয়ার পর আবিরের বোন বললো....
-ভাইয়া, একটা কথা জানো?
-কি কথা?
-তুমি না খেয়ে আসছো বলে, মা ও এখনো খায় নি। মাছ রান্না করে আমায় বলেছে, তোমাকে না খায়িয়ে মা খাবে না। তোমার না খাওয়ার জন্য মা মনে হয় কেদেছে।
আবির এবার আর কান্না ধরে রাখতে পারলো না, তার চোখর পানির জন্য আপনা আপনি পুরো মুখটা ভিজে যাচ্ছিল। তখন আবিরের মা এসে বললো...
-কি হয়েছে, কাদছিস কেন?
-কই কাদছি না তো, চোখে যেন কি গিয়েছে।
-কি গেল আবার চোখে ভিতরে? দেখি...
-কিছু হবে না, পানি দাও। পানির ছিট দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া শেষ করে আবির তার মা ও বোনকে বিদায় দিয়ে সেই রুমটায় বসে অনেক্ষন কেদেছে, নিজেকে খুব বড় পাপি মনে করেছে, কেন সে এই "মা" নামক সহজ সরল মহিলাটির সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে? মায়ের মনে কষ্ট দেয়ার জন্য নিজেকে অনেক দোষ দিয়েছে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, আর কখনো এই মায়ের মনে কষ্ট দিবে না।
শেষকথাঃ- গল্পের আবির নামের ছেলেটি আর কেউ নয় সেটা আমি নিজেই, সেদিন অনেক কেদেছিলাম সেই রুমটায় বসে। মায়ের ভালবাসার তীব্রতা দেখে, মায়ের মায়াময়ী মনটা দেখে আর আমার হীনমান্যতার কথা চিন্তা করে সেদিন কান্না থামাতে পারছিলাম না। আমি জানি আমি আমার প্রতিজ্ঞা পরে আরো অনেক বার ভেঙ্গেছি কিন্তু প্রতিবারই মা আমাকে ক্ষমা করে তার ভালবাসা দেখিয়েছে।

লেখক=> Mishadul Islam